শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১৮

পালট - মাহরীন ফেরদৌস (একুয়া রেজিয়া)

মাহরীন ফেরদৌস (একুয়া রেজিয়া) এর ছোট গল্প: পালট
---------------------------------------------------------

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে জানালায় তাকালেই দেখা যায় একটা দাঁড়কাক। রেলিংয়ের সাইড ঘেঁসে ছোট্ট ছোট্ট লাফ দিয়ে চলছে। দাঁড়কাকের বাম পা’টি ডান পায়ের চেয়ে একটু ছোট, তাই দাঁড়কাকের হাঁটার ধরণ দেখলেই মনে হয় পাখিটা লাফ দিচ্ছে। এক্কা দোক্কা খেলার মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। আলেয়া সুলতানা প্রতিদিন ভোরবেলা আলো ফোটার পরই জানালায় তাকিয়ে প্রায় তিন থেকে পাঁচ মিনিট এই দৃশ্য দেখেন। তারপর বিড়বিড় করে কাকটাকে কুৎসিত সব গালি দেন। এই কাকটিকে দেখতে তাঁর অসহ্য লাগে। গালি দিতে দিতেই তিনি হাতমুখ ধুতে চলে যান, রান্নাঘরে গিয়ে নাস্তা বানান। ঘন্টাখানেক এর মধ্যেই নাস্তা বানিয়ে, ছেলে এবং ছেলের বউকে অফিসের জন্য বিদায় করে ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টেলিভিশন দেখেন।

টেলিভিশন দেখার সময়ে মাঝে মাঝে তিনি সেন্টার টেবিলে পা তুলে দেন। তাঁর গোলাপি রঙের ম্যাক্সি তখন পায়ের গোড়ালি থেকে বেশ উপরে উঠে যায়। আলেয়া বার বার ম্যাক্সি টেনে পায়ের গোড়ালির কাছ পর্যন্ত টেনে দেন। গোলাপি ম্যাক্সির নীচ থেকে এত ফর্সা পা বের করে রাখা ঠিক না। যদি ওরা দেখতে পায়, তাহলেই কানের কাছে এসে নানা কথা বলবে। যদিও ওরা দিনে আসে কম। রাতেই বেশি আসে। তবুও তাদের কোন ঠিক নেই। এই তো সেদিন ভরদুপুরে ছুটা কাজের লোকটাকে দিয়ে কাজ করিয়ে, সব রান্না শেষ করে যেই না আলেয়া ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করেছেন, ওমনি ওরা চলে এলো। কানের কাছে এসে একসাথে সবাই ফিসফিস করে বলল- কীরে? অবেলায় ঘুমাবি? ঘুমাবি, ঘুমাবি? আলেয়া কানের ওপর হাত চেপে ধরলেন, তাতে কোনই লাভ হলো না, মাথার ভারী বালিশটা চেপে ধরলেন তাও ওরা বলতেই থাকল, ঘুমাবি, ঘুমাবি, ঘুমাবি? একসময় আলেয়া ওদের কথা শুনতে শুনতে বিভ্রমে পড়লেন। তাঁর মাথা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকল। তাই সে বিছানা থেকে দ্রুত নেমে বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে থাকল। মাগরিবের আজানের সময়ও ঘরে ঢুকলো না, কানের ভেতর ফিসফাস, মাথার ভেতর যন্ত্রণা, চোখের মাঝে লাল মরিচের জ্বলুনি নিয়ে সে গাঁট মেরে বসে থাকল চেয়ারে। ছেলে আর ছেলের বউ রাত করে বাড়ি ফিরে এলে আলেয়া তাদের সাথে ঘরে ঢুকল।

আলেয়া কেন এমন, তা নিয়ে যে কারও প্রশ্ন জাগতে পারে মনে। আলেয়া সুলতানা ছিল এক সময় ঢাকার ওয়ারীর নামকরা সুন্দরী। পাড়ার সকলে একনামে তাঁকে চিনত। নীল, সাদা ইউনিফর্ম পরে সে যখন কাঁধে ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেত পাড়ার ছেলেরা লাইন ধরে চিঠি নিয়ে অপেক্ষা করত। সেই চিঠিতে কেউ আলেয়াকে বলত, সুচিত্রা, কেউবা সুচরিতা। অজস্র চিঠি পেলেও আলেয়া কখনও কোন চিঠির উত্তর দেয় নি। তাঁর মাঝে অহং বোধ ছিল। আর একইসাথে মনের কোথায় যেন ছিল এক টুকরো মেঘের বিষণ্ণতা। কাউকে যেচে মনের কোন কথা বলতে তাঁর বাঁধত। সে চিঠিগুলো জমাত। সাতষট্টিটা চিঠি জমেছিল। অবসর সময়ে সেই চিঠি পড়ত আলেয়া। সব চিঠির লাইন, শব্দ দাড়ি কমাসহ তাঁর মুখস্ত ছিল। কিন্তু তবুও সে পড়ত। বার বার পড়ত। একই বই বার বার পড়ার, একই সিনেমা বার বার দেখার অভ্যাস আছে তাঁর। পুরানো যে কোন কিছুতে ফিরে যেতে আলেয়ার বড় ভালো লাগত। এমনি করে ফিরে যাওয়াতে বড় নেশা আছে। এভাবেই দিব্যি দিন কেটে যেতে পারত, কিন্তু কলেজে ওঠার কিছুদিন পরেই একদিন হুট করে বিদেশ ফেরত এক উকিলের সাথে বিয়ে হল তাঁর। পাত্রপক্ষ প্রথমবার দেখতে আসার দিনই সোনার আংটি পরিয়ে গেল। তাঁদের বিশাল দোতলা বাড়িতে সাজ সাজ রব পড়ে গেল নিমিষেই। কাবিন হল পাঁচ দিনের মাথায়। ওয়ারী এলাকার সবচেয়ে রূপসী আলেয়া চলে এল গুলশান। আলেয়ার শ্বশুর মস্ত বড়লোক। বাড়ির বাইরে চব্বিশঘন্টা প্রহরীর মত থাকে দারোয়ান। গ্যারাজে থাকে দুটা গাড়ি, একটা লাল আর আরেকটা সাদা। আলেয়া ভাবল সে আর তাঁর স্বামী, দুজন মিলে খুব ঘুরবে গাড়ি করে। জলপাই সবুজ শাড়ি পরে, সাথে মিনা করা সোনায় গয়না পরে সে সিনেমার নায়িকার মত ঘুরতে বের হবে। সে হবে ‘চাওয়া পাওয়া’ সিনেমার সুচিত্রা সেনের মত মেমসাহেব। গল্পটা এখান থেকেই সিনেমা মত হতে পারত কিন্তু তা হল না, বিয়ের পর দিন যায়, মাস যায় আলেয়ার আর ঘুরতে যাওয়া হয় না, মনের মধ্যে সুখ সুখ আনন্দ পাওয়া হয় না। আলেয়ার উকিল স্বামী ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে রোজ তাঁকে ফেলে চলে যায়। আর দিনশেষে যখন ফিরে আসে তখন আর কোন কথা শোনার মত সময় থাকে না তাঁর।

মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গুলশানের বাড়ির একটা ঘরে দিন কাটে আলেয়ার। সেই ঘরের জানালাগুলো দিয়ে আলেয়া মেঘবাদলের খেলা দেখে, গ্যারাজ থেকে লাল কিংবা সাদা গাড়ির আসা যাওয়া দেখে। বিছানার চাদরের কোণগুলো টান টান করে রাখে। জলপাই, লাল, নীল, কমলা শাড়িগুলোতে হাত বুলায়। ডিম্বাকৃতি আয়নায় তাকিয়ে কপালে মস্ত বড় টিপ পরে। মীনা করা সোনার গয়না, বালা পরে থাকে। মাসশেষে নাকছাবি বদলায়। সপ্তাহ, সপ্তাহ হরেক রকমের রান্না করে। আলেয়ার দিন পলকে কেটে যায়, কিন্তু রাত কাটে না। রাতগুলো তাঁর জন্য অসম্ভব রকমের লম্বা হয়ে যায়। এমনই এক মধ্য রাতে আলেয়া বুঝতে পারে তাঁর উকিল স্বামী কখনও আলেয়াকে চায় নি, তাঁর প্রয়োজন ছিল শুধুই একজন সুন্দরী স্ত্রীর, যে কিনা তাঁকে রেঁধে খাওয়াতে পারবে, রাত করে দৈহিক চাহিদা মিটিয়ে দিতে পারবে, ঘরের সবকটা জিনিস গুছিয়ে রাখতে পারবে। সেখানে আলেয়া থাকুক কিংবা রাবেয়া, মমতা, মুনিয়া সবই এক। আলেয়ার মনেও যে সিনেমার রুপালী পর্দার মত বিশাল এক পর্দা আছে, সেই পর্দায় যে আলেয়ার কত আবেগ, কত স্বপ্ন, কত সুর, গান আর ভাবনা খেলা করে তা দেখার কোন সময়ই তাঁর নেই। সত্যিই নেই। সেই রাতে এসব ভাবতে ভাবতে আলেয়া অস্থির হতে থাকে, তাঁর মাথায় অস্থিরতার চরকা ঘুরতে থাকে। সে ঘুমন্ত স্বামীর পাশ থেকে উঠে যায়। তারপর বিছানা থেকে নেমে এক লহমায় ঘরের সবকটা জানালা খুলে দেয়। আলতো করে আলমিরার লকার খুলে কিছু সোনার গহনা নেয়। অল্প কিছু টাকা নেয়। দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। প্রশ্ন থাকতে পারে এত পাহারার মাঝে আলেয়া কীভাবে সে বাড়ি থেকে বের হয়েছিল? বাড়ির মূল দরজার পাহাদার আলেয়াকে দেখামাত্রই আটকে ফেলতে চেয়েছিল, কিন্তু সে সোনার মূল্য জানত। তাকে বাগে আনতে আলেয়ার তাই আর সময় লাগে নি।

একই সিনেমা বার বার দেখতে, একই বই বার বার পড়তে আর ফিরে আসতে পছন্দ করা আলেয়ার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে আসাটা সহজ হয় নি। সে বুঝতে পেরেছিল ফিরে আসাটা আসলে সহজ নয় মোটেও। তাঁর ফিরে আসা মেনে নেয় নি বাবা-মা, বড় ভাই এবং ভাবীরা। মেনে নেয় নি কোন মামা কিংবা চাচার পরিবার। শুধু তাঁকে দু হাত বাড়িতে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল আলেয়ার স্কুল পড়ুয়া বান্ধবী হাফসার মা, পরী বেগম। হাফসা তাঁর প্রথম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিল। আর ওর স্বামী মাত্র দু মাসেই খুঁজে নিয়েছিল নতুন জীবন সঙ্গী। স্বামীহারা, কন্যাহারা পরী বেগম হাফসার পুত্র সন্তান অনীককে নিয়ে একা থাকতেন। তিনি আলেয়াকে পেয়ে যেন নতুন আলো খুঁজে পেলেন। একহাতে তিনি ধরলেন হাফসার ছেলেকে আর অন্য হাতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন আলেয়াকে। তারপর ঝরঝর করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন- আমার হাফসা ফিরা আইসে...

আলেয়াকে যদি প্রশ্ন করা হয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কোনটি? সে নিঃসন্দেহে বলবে, যতদিন পরী বেগম বেঁচে ছিলেন ততদিন সে তার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় কাটিয়েছে। পরী বেগম পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকেই কে বা কারা যেন আলেয়ার কানে বিড়বিড় করে, ফিসফাস করে নানা কথা বলে। ওরা আলেয়াকে একলা থাকতে দেয় না, রাতে বেশিক্ষণ ঘুমাতে দেয় না। অনীক বলে এটা নাকি মনের অসুখ। কিন্তু আলেয়া জানে এ অসুখ না। তাঁর মাথার ভেতরে অজস্র শয়তানের বসবাস। যে শয়তানগুলো আজীবন তাঁকে জীবনের ভুল অর্থ শিখিয়েছে। এই শয়তান সবার মনের থাকে। কেউ তাদের শুনতে পায় কেউ পায় না। আলেয়া চাইলেও মুক্তি পাবে না তাদের কাছ থেকে। সারাক্ষণ এই যন্ত্রণা নিয়েই থাকতে হবে তাঁকে। এটাই তাঁর জীবন।
কিন্তু আলেয়াকে ভুল প্রমাণ করে বহু বছর আগের মত আলেয়ার জীবনে দ্বিতীয়বারের মত মুক্তি আসে। আবারও এক মধ্যরাতে আলেয়ার ছোট্টঘরের জানালা গলে জ্যোৎস্না আসে। সেই জ্যোৎস্নার আলোতে ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। অনুভব করতে পারে, বহুদিন পর কানের মধ্যে কোন শব্দ নেই, কথা নেই, ফিসফাস নেই। বুকের মধ্যে যেন ঢেউ ছলাৎ করে উঠে আনন্দে। রুপালী জ্যোৎস্না দেখে আলেয়া আবার এক কাপড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে। ঘর থেকে বেরিয়ে এক পা দু পা করে সে হাঁটতে থাকে। চাঁদের আলোয় দেখা যায় শাড়ি পরা এক মধ্যবয়স্কা মহিলা খালি পায়ে একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আর তাঁর পিছু পিছু ছোট ছোট লাফ দিয়ে যাচ্ছে একটা দাঁড়কাক। নিঝুম রাতের কমলা আলোয় দেখা যায় রাস্তায় এক নারীর আর একটি পাখির তীর্যক ছায়া নেচে বেড়াচ্ছে...

ফিরে যাওয়ার চেয়ে বুঝি চলে যাওয়া অনেক সহজ...

======================================

(অমৃতবাজার পত্রিকায় ১৭ আগস্ট ২০১৬ তারিখে প্রকাশিত)

© Copyright : মাহরীন ফেরদৌস (একুয়া রেজিয়া)

﹋﹋﹌﹋﹋﹌﹋﹌﹌﹋﹋﹌﹋﹌﹋﹌﹌﹋﹋﹌﹋﹌﹋﹋﹌﹋

** Note: ® [This is one of my Favorite Bangla Articles. I own none of the content within the post, only the drafting/typing time spent. No copyright infringement intended. The contents of this post are the intellectual property and copyright of their owner(s)/author(s). All content is owned by its respective owner(s)/companies. If you own any of the content and wish for me to remove this post from my personal blog (Dhumkeatu's Diary - A personal online diary : Where I Wandered Lonely as a Cloud...) please contact me and I will do so. Here this post is provided for educational purposes and personal use only. Thank you.]

﹋﹌﹋﹌﹋﹋﹌﹋﹌﹌﹋﹋﹌﹋﹌﹋﹌﹌﹋﹋﹌﹋﹌﹋﹋﹌﹋

*** N.B : [All the post on this blog (Dhumkeatu's Diary) is only for Personal Collection/Personal use only. There are no other intention to Plagiarism on any others post or content. Advance apologize for any objection of any Author, Publisher, Blog, Website & the others printing media for posting/re-posting any contents on this Personal Blog - "Dhumkeatu's Diary - A personal online diary : where I Wandered Lonely as a Cloud."]

*** Believe : "Happiness is a Choice & Life is Beautiful."
''Zindagi Na Milegi Dobara." Just keep Livin...!!!
Keep Smile.......!! Happy Living......!!! :) :) :)
Thank You, Good Luck......!!! :) :) :) 🌷🙏🌷

*** Posted by : © "Dhumkeatu's Diary" || 06.07.2018 || 🇧🇩

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

প্রিয় গানের সংক্ষিপ্ত তালিকা...

**প্রিয় গানের সংক্ষিপ্ত তালিকা... ১) মন শুধু মম ছুঁয়েছে- সোলস ২)নিঃস্ব করেছ আমায় - শাফিন ৩)ফিরিয়ে দাও- মাইলস ৪)শ্রাবনের মেঘগু...