শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

ছোট গল্প : "অতল সাগরের রহস্য সে চোখের চাহূনিতে"



 ছোট গল্প : "অতল সাগরের রহস্য সে চোখের চাহুনিতে"
©  "ধূমকেতু"
------------------------------------------------------------------------------

হঠাৎ নীরার জন্য - সুনীল দা'র বুকের বাম পাশের দু'বিঘা জমিতে ভূকম্পন শুরু হলো। উফ... ভীষন যন্ত্রণা; দারুণ যন্ত্রনা; মধুর সে যন্ত্রণা! এই যন্ত্রনা টুকুন শুরু হওয়ার পরই, সুনীল দা'কে বরুণার দেওয়া ৩৩ বছর ধরে কথা না রাখার যন্ত্রণা গুলো সব এক নিমিষেই ম্লান হয়ে গেল। যদিও তার আর নীরার মাঝখানেও এখন - শুয়ে থাকে নীলাভ ও বেগুনি রঙের দু'কোটি আলোকবর্ষের স্তব্ধতা!

বাইরে বৃষ্টি, ভীষন বৃষ্টি! এই মায়াবী দিনে, আজকের এই বৃষ্টিস্নাত দিনে নীরাকে এক পলক না দেখলে যুগের পর যুগ আক্ষেপ করতে হবে। তাই সুনীল দা নীরার সাথে দেখা করার সির্দ্ধান্ত নিয়েছেন। সুনীল দা জানে, নীরা প্রতিদিন বিকেলে তার জন্য নীল শাড়ী পরে উত্তর - বেলকুনিতে অপেক্ষা করে। কিন্তু সে যায় না। সে যেতে চায় না। আর যেতে চাইলেও যেতে পারে না। নীল আর সাদা সুনীল দা'র সবচেয়ে প্রিয় রঙ গুলোর দু'টি। সাদা ব্লাউজ আর নীল রঙয়ের শাড়ীতে নীরাকেও সদ্য জন্ম নেওয়া কবিতার মত অদ্ভুত রকমের ভালো লাগে। সুনীল দা'রও ইচ্ছে করে ঐ কবিতায় ডুবে গিয়ে ছন্দে ছন্দে অন্তমিল হয়ে শত-শতাব্দী ধরে জড়িয়ে থাকতে!

প্রায় ৫ মাস আগে নীরার সাথে তার শেষ দেখা হয়েছিল যান্ত্রিক এক শহরের পিচ ঢালা কোন এক পথে (এ যেন এক তৃষ্ণার্ত যাযাবর মরুভূমিতে খুজে পেল এক ফোঁটা অমৃত) কিন্তু কথা হয়নি! বৃষ্টির মধ্যে নীরা চৌরাস্তায় ট্যাক্সি খোঁজাখুঁজি করছিলো। সুনীল দা তখন চলন্ত ট্রামের জানলায়। তার বেশ কিছু মাস আগে তাদের দেখা হয়েছিল : সুনীল দা তখন মুচির সামনে বসে ছেঁড়া চটি সেলাই করাচ্ছিল আর ফরাসি চলচ্চিত্র উৎসব থেকে নীরা বেরিয়ে আসছিল খুশির প্রতিমা হয়ে। তার কিছু দিন আগে নীরা মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে সুনীল দা'কে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, কিন্তু তাকে দ্রুত নেমে যেতে হয়েছিল পাতাল রেলে। বছর খানেক আগে তাদের একদিন মুখোমুখি দেখা হয়ে গিয়েছিল, সেদিন আগুন জ্বলছিল সারা শহর জুড়ে, সমস্ত লোক চিৎকার করছিল অন্যরকম কন্ঠস্বরে, এ রকম সময় কথা বলতে নেই, কথাগুলি সব নিঃস্ব হয়ে যায়। এক একটা ভুল কথায় নষ্ট হয়ে যায় কবিতা, প্রজাপতির গায়ে আগুনের আঁচ লাগার মতন ভুল শব্দে পুড়ে যায় ভালোবাসা। সেদিন সুনীল দা শুধু নীরার চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়েছিলেন। নীরার সামনে গেলে সুনীল দা'র এখনো কেমন যেন হয়, একি প্রেম নাকি ভয় তা তিনি আজো বুঝে উঠতে পারেননি। সে যাই হোক একদিন সুনীল দা নীরার খুব নিকটে পৌঁছে গিয়েছিলেন, পৃথিবী তখন ঘুরছিল কিনা তা তিনি জানেন না, তিনি শুধু বুঝেছিলেন তার হৃদ-স্পন্দন ক্ষনীকের জন্য থমকে গিয়েছিল। "আজ আবার এই পথে দেখা হয়ে গেল, শুধু ভালো আছো তো, ভালো আছো তো... " গানটা তখন সুনীল দা'র হৃদয়ের ক্যাসেটে খুব করে বাজছিল। তার খুউউউউব ইচ্ছে হচ্ছিল নীরাকে একবার জিজ্ঞাস করতে "নীরা ভালো আছো তো?" কিন্তু প্রশ্নটির জন্মের সাথে সাথে মনের মধ্যেই মৃত্যু ঘটেছিল সেদিন তার। দূর থেকে তিনি ছল ছল চোখে চেয়ে দেখেছিলেন নীরার চলে যাওয়া...। নীরাকে এক পলক না দেখে থাকাটা সুনীল দা'র জন্য যে কি কষ্টের সে কথা নীলাকাশ ছাড়া আর কেউ জানে না; তাই ঐ নীল ঢেকে যায় কালো মেঘে।

শার্ট গুলো মলিন হয়ে আছে; ছোটবেলায় সুনীল দাও খুব স্মার্ট ছিলেন, তার বয়স যখন ৬ মাস, প্রতিদিন ৪-৫ বার পোশাক চেঞ্জ করতেন। এখন একি ড্রেসে ৪-৫ দিন কাটিয়ে দেন। আর জিন্সটা ৪-৫ মাস পর পর ধুয়ে দেওয়ার সময় পান। ভাঙা চৌকির তলার স্বপ্নের বাক্স থেকে তার ফুফুর দেয়া হলুদ পাঞ্জাবীটি বের করলেন, এটি পরেই তিনি আজ নীরার সাথে দেখা করতে যাবেন। পকেট একদম ফাঁকা, তাই হেঁটেই যাবেন সুনীল দা। ঘরে কোন ছাতা নেই শেষমেশ তিনি ভিজেই রওনা দিলেন। যাওয়ার আগে হাতে নিলেন তিন বছর আগে লেখা একটি মলিন চিঠি; তার লেখা প্রথম প্রেমপত্র। নীরাকে তিনি প্রথম যেদিন দেখেছিলেন, সেদিন শেষ রাতে লিখেছিলেন। একাকী দাঁড়কাকের মত তিনি এখনো সারা রাত জাগেন। রাত জাগার অভ্যাস সুনীল দা'র সেই ক্লাস সেভেন থেকে, তখন রাত জাগতেন কবিতা লিখতে, আর এখন রাত জাগেন হারানো সত্তা খুঁজতে। তিনি নীরার কাছ থেকে প্রত্যাক্ষিত হওয়ার ভয়েই চিঠিটা কোনদিন দেননি। যেসব নারীকে তিনিও গোপনে ভালোবেসেছেন, তাদের সঙ্গে তার কখনও বিচ্ছেদ ঘটেনি। পক্ষান্তরে তার প্রকাশিত প্রেমসমূহ পূর্ণ হয়েছে বেদনায়, বিচ্ছেদে। তাই তিনিও নির্মলেন্দু গুণের মত মনে করেন, "প্রকাশিত প্রেমের তুলনায় অপ্রকাশিত গোপন প্রেমই ভালো। যাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে, তাকেই গোপনে ভালবাসা যাবে। যাকে ভালোবাসি তাকে কখনও তা জানতে দেবো না। আমার প্রেম প্রত্যাখ্যান করার কোনো সুযোগই সে পাবে না। আমি তাকে ইচ্ছমতো ভালোবাসবো। প্রাণ ভরে ভালোবাসবো। যতদিন খুশি, যতবার খুশি ভালোবাসবো।" এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকে সুনীল দা ভালো আছেন। শুধু ভালো নয়, খুব ভালো আছেন। প্রেম নিয়ে তারও সকল উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অবসান হয়েছে। প্রিয় নারীদের ভালোবেসে তিনিও এখন পরম স্বস্তিতে আছেন। তার আর কোনো ভয় নেই।

সুনীল দা পাশের ঘরে গেলেন বডি স্প্রে নিতে, বডি স্প্রে তে তার এর্লাজি থাকায় নিজে কেনেন না খুব একটা, শুধু তাই নয় গোলাপ ফুলের সুবাসেও তার এর্লাজি। তাই নীল অপরাজিতা তার প্রিয় ফুল। বাইরে বৃষ্টি; কিন্তু আজ নীরার সাথে দেখা করতে যাওয়া বলে কথা; এই শ্রাবণে নীরার সাথে দেখা করতে যাওয়া বলে কথা, তাই ভালো করে স্প্রে লাগালেন শরীরে। নীরার জন্য তিনি সব করতে পারেন। নীরার ভালোবাসা পেলে তিনিও সব লন্ডভন্ড করে চলে যেতে পারেন যেদিকে দুচোখ যায়, যেতে তার খুশি লাগে খুব । চৌকাঠ পার না হতেই পুরনো চটি স্যান্ডেলের একটা ছিঁড়ে যাওয়ায় সর্ম্পূন খালি পায়ে গিয়ে উঠলেন কেরামত কাকার দোকানে। চিঠিটা বৃষ্টির তান্ডব থেকে বাঁচাতে একটি পলি ব্যাগ নিয়ে হাটা শুরু করলেন খালি পায়ে। পেছন থেকে কেরামত কাকা বলে উঠলেন, "আজ চা না খেয়েই পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবী পরে কই যাও মিয়া?" সুনীল দা পেছন ফিরে বললেন "কাকা, আজ আমার হিমু দিবস। তাই হিমু যেমন খালি পায়ে, পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবী পরে রূপার সাথে দেখা করতে যেত, তেমনি আমিও যাচ্ছি নীরার সাথে দেখা করতে"। পেছন থেকে শোনা গেল, "অশ্রুত" - ব্যান্ডের "মাটির রোদ" গানের "দিচ্ছি আজ প্রথম চিঠি বৃষ্টি বিন্দুর কালি মেখে, দেখছি আজ নতুন ধরা তোমার দু'চোখ দিয়ে..." এই লাইন টা সুনীল দা গাইতে গাইতে অদৃশ্য হয়ে গেলেন গলির বাঁকে।

কাকভেজা হয়ে সুনীল দা পিচ ঢালা পথ ধরে, খালি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন মন খারাপের গলির দিকে। (নীরার বাসার সামনের গলি কে তিনি "মন খারাপের গলি" বলে ডাকেন! এই গলিতে আসলে তার নাকি মন খারাপ হয়ে যায়! তার অনেক অভিমানের বন্ধ দরজায় বিষাদ এসে নাকি কড়া নাড়ে!) হঠাৎ একটি পুরাতন বাড়ির দেওয়ালে কিছু নীল অপরাজিতা দেখতে পেয়ে সুনীল দা নীরাকে দেওয়ার উদ্দেশ্য ছিঁড়ে হাতে নিলেন। প্লান করে ফেলেছেন "বৃষ্টিস্নাত নীলোপরাজিতা" শিরোনামে একটি কবিতা লিখবেন অবসরে। নীরাকে তিনি কি কি বলবেন তা মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন। অনেক কথা জমে আছে এই তিন বছর ধরে। বছর দুই আগেই তিনি ঠিক করে রেখেছেন কি কি বলবেন। সব কথা তার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। তবুও প্রথমে বলবেন হুমায়ূন আজাদ - এর  কয়েক টি লাইন : নীরা - "অজস্র জন্ম ধরে আমি তোমার দিকে আসছি কিন্তু পৌঁছুতে পারছি না। তোমার দিকে আসতে আসতে আমার এক একটা দীর্ঘ জীবন ক্ষয় হয়ে যায় পাঁচ পঁয়সার মোম বাতির মত। আমার প্রথম জন্মটা কেটে গিয়েছিলো শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দেখে, এক জন্ম আমি শুধু তোমার স্বপ্ন দেখেছি। আমার দুঃখ, তোমার স্বপ্ন দেখার জন্যে আমি মাত্র একটি জন্ম পেয়েছিলাম।" তারপর বলবেন : James Frey - এর একটি Quote : নীরা "When I see you, the World stops. It stops and all that exists for me is you and my eyes staring at you. There's nothing else. No noise, no other people, no thoughts or worries, no yesterday, no tomorrow. The World just stops, and it is a beautiful place, and there is only you. Just you, and my eyes staring at you." তারপর বলবেন : "নীরা তোমার সাথে প্রতিটি কথাই কবিতা, প্রতিটি মুহূর্তই উৎসব - তুমি যখন চলে যাও সঙ্গে সঙ্গে আমার পৃথিবীরও সব আলো নিভে যায়, বইমেলা জনশূন্য হয়ে পড়ে, আমিও কবিতা লেখা ভুলে যাই।" তারপর বলবে: "নীরা আষাঢ়-শ্রাবণের কোন এক রাতে চুপচাপ তোমেকে পাশে নিয়ে বসে থাকতে পারলেই হবে আমার। আর কিচ্ছু চাই না, শুধু যখন বিলবোর্ডের উপর একটা পাখি এসে বসবে তখন একটু তোমার চোখের দিকে তাকাতে পারলেই জীবনে আর কিছু লাগবে না।" তারপর কয়েক সেকেন্ড শুধু নীরার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন অপলক দৃষ্টিতে আর বলবেন, "নীল শাড়িতে তোমাকে অনিন্দ্য সুন্দর লাগে।" তারপর সেই ঐতিহাসিক প্রেমপত্রটি বের করে নীরার হাতে দিয়ে বলবেন, "আমি চলে যাচ্ছি নীরা... শুধু তোমার হাতের এক কাপ চা খেতে চাই যাওয়ার আগে। নীরা... এ আমার আজন্ম লালিত ইচ্ছে- কোন এক শ্রাবণে এমন মায়াবী বৃষ্টি দিনে তোমার পাশে দাড়িয়ে এক কাপ চা খাব!"

এত্তসব মধুর মধুর কল্পনার মাঝে, হঠাৎ সুনীল দা'র মন খারাপ হয়ে গেল; খুউউউউব খারাপ! তিনি বুঝেছেন যে তিনি - মন খারাপের গলিতে এসে গিয়েছেন। হাতের বাম দিকের তিন বাড়ি পরেই নীরার বাড়ি। আর সেই বাড়ির উত্তর - বেলকুনিতে নীরা নীল শাড়ি পরে অপেক্ষা করছে তার জন্য। এবার সুনীল দা'র মনে পরে গেল, রূপাকে নিয়ে বলা হিমুর কথাটি - "সে অপেক্ষা করে। আমি কখনো যাই না। আমাকে তো আর দশটা ছেলের মত হলে চলবে না। আমাকে হতে হবে অসাধরণ। আমি সারাদিন হাটি। আমার পথ শেষ হয় না। গন্তব্যহীন যে যাত্রা তার কোনো শেষ থাকার তো কথাও নয়।” তাই সুনীল দা সির্দ্ধান্ত নিল যে - সেও নীরার সাথে দেখা করবে না। তাকেও যে হতে হবে অসাধারণ।

সৌভাগ্য ক্রমে, গলির পথে সুনীল দা'র সাথে দেখা হলো নীরার বাড়ির কাজের ছেলে : ছোটকু -এর সাথে। "সুনীল দা - তুমি! কত্তদিন পর এলে" বলে ছোটকু তাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, "দাদা, নীরা দিদি ঐ উত্তরের ঝুল বারান্দায় নীল শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে। তুমি চলো।" সুনীল দা বললেন - নারে ছোটকু, আজ নয়, অন্য আর একদিন আসব। তুই শুধু এই "চিঠিটা আর এই একগুচ্ছ নীল অপরাজিতা" তোর দিদির হাতে দিস। আর ভাল থাকিস। বিদায়। এই কথা বলে সুনীল দা ধীরে ধীরে গলির বাঁকে হারিয়ে গেলেন।

নীরার সাথে দেখা না করায় সুনীল দা'র মন ভাল নেই। হিমুর মত সুনীল দা'র ও একটা ময়ুরাক্ষী নদী আছে। সুনীল দা'র মন খারাপ হলে হিমুর মত তিনিও ময়ুরাক্ষীর তীরে গিয়ে বসে থাকেন। সারাদিন বসে থাকেন। সারারাত বসে থাকেন। রাতে একাকী জ্যোৎস্না বিলাস করেন নিঃসঙ্গ যাযাবরের মত। বেশ কয়েক দিন বাড়ি ফেরেন না। তাই আজো তিনি ময়ুরাক্ষীর তীরে যাবেন। সেখানে বসে "অতল সাগরের রহস্য সে চোখের চাহুনিতে" শিরোনামে নীরাকে উৎসর্গ করে চৌদ্দ লাইনের একটি কবিতা লিখবেন।

বিকেল গড়িয়ে, গোধুলী শেষে, সন্ধ্যা ফুরিয়ে রাত নেমে এসেছে পৃথিবীতে, ভয়ংকর সুন্দর জ্যোৎস্না মাখা বৃষ্টিস্নাত এক রাত। সুনীল দা বসে আছেন তার কল্পলোকের ময়ুরাক্ষীর তীরে। তার খুউউউউব ইচ্ছে হচ্ছে নীরাকে এক পলক দেখার। তার প্যারাডক্স মন একবারের জন্য নীরার দরজায় কড়া নাড়তে চাইছে, আবার চাইছে না। এই প্রথম সুনীল দা চাওয়া আর না চাওয়ার মাঝখানে অবস্থান করছেন। G. B. Shaw - এর "There are two tragedies in life. One is to lose your heart's desire; The other is to gain it." - এই Quote টি বার বার নিজেকে বলে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। তিনি নিজেকেই আরো বলছেন : "শোন সুনীল - তুই ভালবাসিস স্বপ্ন দেখতে, জানি তোর স্বপ্নগুলো কখনোই পূরন হবেনা। আর পূরন হবার দরকারটা কি??? সব স্বপ্নই যদি পূরন হয় তাহলে স্বপ্ন দেখার কোন মানেই হয়না। স্বপ্ন দেখা হয়ে যায় অর্থহীন। তার চেয়ে স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থাক। ওগুলোই তোকে বাঁচতে শেখাবে। তোকে বেচে থাকার আলো দেখাবে। তুই শুধু বাঁচার মত বেঁচে থাক। স্রেফ বেঁচে থাকলেও জিবনে অনেক কিছু হয়। " সব সময় মনে রাখবি : "Happiness is a choice & Life is beautiful. Let's Live Life."

ঐদিকে প্রতিদনের মত অপেক্ষা-ক্লান্ত নীরা নীল শাড়ি পরিহিত অবস্থায় বেডে শুয়ে "Ivan Turgenev" - এর "On the Eve" পড়ছে। ছোটকু এসে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল "নীরা দি, বিকেলে সুনীল দা এসেছিল, এই চিঠিটা আর এই ফুল গুলো আমাকে দিয়ে বলেছিল তোমাকে দিতে; আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এই নাও দিদি - বলে "চিঠিটা আর একগুচ্ছ নীল অপরাজিতা" নীরার হাতে দিয়ে চলে গেল। কত কাল ধরে নীরা সুনীল দা'র জন্য অপেক্ষারত কিন্তু সে আজ বাড়ির কাছে এসেও দেখা করলো না? এই অভিমানে নীরা চিঠিটা চার টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিল বেডের উপরে, তারপর কয়েকটি নীল অপরাজিতা বইয়ের ভাঁজে রেখে এবং বাকি ফুল গুলো হাতে নিয়ে ঘর থেকে চলে গেল উত্তর - বেলকুনিতে। নীরা রেলিং ধরে দাড়িয়ে আনমনে কয়েক টি ফুল ছিঁড়তে থাকল । এখন "ভেতর বলে দূরে থাকুক বাহির বলে আসুক না" এই গানটার রিহার্সাল চলছে তার ভেতরে। রাত একটা বাজে। অবশেষে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে বাহিরেরই জয় হলো।
নীরা আঠা দিয়ে চিঠিটা জোড়া লাগাল। তার হাত কাঁপছে - চিঠিটা ধরে রাখতে। নীরা চিঠিটা পড়া শুরু করতেই হতাশ হল। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। সে বুঝেই উঠতে পারছে না চিঠিটা বাংলা, হিন্দী, উর্দু নাকি ফার্সি তে লেখা। হঠাৎ চিঠিটার উপরের ডান দিকে চোখ পড়ল নীরার। ছোট্ট করে লেখা আছে "আয়নায় দেখ"। নীরা আয়নার সামনে চিঠিটা ধরতেই সব লেখা বুঝতে পারল। চিঠিটা উল্টো বাংলা ফ্রন্টে - হাতে লেখা। নীরার বুঝতে বাকি থাকলনা, চিঠিটা লিখতে সুনীল দা'র কতটা কষ্ট হয়েছে। এটা সুনীল দা'র লেখা চিঠি, ব্যতিক্রম আর অসাধারণ হবে, ভেবেই নীরা চিঠিটা পড়া শুরু করল : প্রথমেই তারিখ লেখা আছে "18.04.2014, 4:09 AM" (নীরার বুঝতে বাকি থাকলনা - চিঠিটা বছর তিনেক আগে লেখা)


"প্রিয় নীরা,

জানি ভালো আছ। এই ভালটা যেন সব সময় থাকা হয়। আজই প্রথম তোমাকে দেখলাম। তখন কে যেন আমার ভেতরে বলে উঠল - "আমি পাইলাম, অবশেষে আমি তাহারে পাইলাম"। তুমি দেখতে ঠিক আমার কল্প দেবীর মতো। নামটাও মিলে গেছে - "নীরা"। তোমাকে শুধুমাত্র "নয়" সেকেন্ডের জন্য দেখতে পেয়েছি। এই "নয় সেকেন্ড" : "Meri jindagi ka sabcheye khub surat 9 seconds hai."। এখন গভীর হাওয়ার রাত, গভীর অন্ধকার রাত। আমি জিবনের প্রথম প্রেমপত্র লিখছি (জানিনা কোন দিন এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছাবে কিনা। যদি পৌঁছায় - তবে সেই দিন হবে আমার জিবনের সেরা দিন গুলির একটি)। বাইরে বৃষ্টি, ভীষন বৃষ্টি। হঠাৎ "রিকল্" - ব্যান্ডের গানটা আমার জিবনে সত্যি হয়ে এলো : "দেখি ভিষণ অন্ধকার মাঝে আলো ছায়ায় তোমার নূপুর বাজে! আমি যে ভেবে ভেবে শিহরিত…" আজ সন্ধ্যায় জয় গোসাম্বির কবিতা পড়ার সময় তোমাকে চোখের সামনে দেখতে পেলাম । এক এক লাইনে তোমাকে এক এক জামায় দেখলাম। আমি তোমাকে দেখি, তোমার সঙ্গে কথা বলা হয় না। (বুঝলাম তোমাকে দেখার পর থেকে স্কিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে গেছি আমি!)

নীরা - আমিও : "কোন মেয়ের প্রেমে পড়িনি এখনও। তবে সুন্দরী মেয়েদের দেখলেই এক পলক তাকিয়ে মনে মনে স্বপ্ন দেখার নামই যদি হয় প্রেম, তাহলে লক্ষ বার প্রেমে পড়েছি!" কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকে এই প্রথম; আমি প্রেম আর অপ্রেমের মাঝে অবস্থান করছি। আমার বুকের বাম পাশের দু'বিঘা জমিতে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে। আগের লক্ষ জনকে দেখার পর এমনটা কোন দিন হয়নি আমার। তাছাড়া ঐ লক্ষ জনের তো তোমার মত দু'চোখ নেই। তোমার দু'চোখ এত সুন্দর কেন নীরা? তোমার আগে শুধু আর এক জনের দু'চোখ; নিজেকে ভাল লাগাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেই দু'চোখের মাঝে আমি শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম ছলনার কালো রঙের এক জোড়া প্রজাপতি, তাই সেই চোখ জোড়া কে আমায় ভাল লাগতে দিয়েছিলাম না শেষ পর্যন্ত। তারপর তোমাকে খুঁজে পেলাম নীরা, এ যে কত যুগের অপেক্ষা তা আমার ঈশ্বর জানেন। আজ তোমাকে দেখার পর ভালোবাসার কথা বলতে গিয়েও কতবার যে আমিও সে কথা বলিনি সে কথা আমার ঈশ্বর জানেন। তোমাকে দেখার পর আকাশপানে তাকিয়ে রুদ্র গোস্বামীর মত আমিও বলে উঠেছিলাম "হে ঈশ্বর মানুষের হৃদপিন্ড থেকে বলছি... বেঁচে থাকা নিষিদ্ধ করো নয়তো ভালবাসাকে ছোঁয়াচে করে দাও। প্রেমের মৃত্যু হোক অথবা ব্যধির মত সংক্রামিত হোক হৃদয় থেকে হৃদয়ে। "

নীরা আজ আমার বলতে দ্বিধা নেই "Golabi aankhe jo teri dekhi, sharabi eh dil hogaya."। আজ সারাটা দুপুর শুধু এই "Ho ek ladki ko dekha to aisa laga, Ek ladki ko dekha to aisa laga, Jaise khilta gulaab, Jaise shaayar ka khwaab, Jaise ujli kiran, Jaise van mein hiran, Jaise chaandni raat, Jaise narami ki baat, Jaise mandir mein ho ek jalta diya..." এই গান টা শুনেছি। আর বিকেল ফুরিয়েছে 3G ছবির এই "Kaise bataaun tujhe ki dil mera kya keh raha. Rahe na faasle ye jo hai apne darmiyaan. Ho… Tere qareeb main ho sakoon. De de tu apni razaa. Paas bithaaun ye zulf sanwaroon. Aur baahon mein le loon tujhe main. Hai dil ki ye khwaahish, Ki sun le guzaarish. Aur de de tu khud ko mujhe. Ho ho… Tujh se mohabbat hui. Hai meri hai bas ye khata. Tujh se main door rahoon. Yeh mujh ko gawaara kahaan. Main tere saath mein hi rahoon. Chhoro ye saara jahaan..." গান টা শুনে। নীরা প্রেমে পরলে বুঝি মানুষ এত গান শোনে? নীরা এই চিঠিটা লিখতে শুরু করার আগেও ROBERTA FLACK - এর এই বিখ্যাত :

"The first time ever I saw your face
I thought the sun rose in your eyes
And the moon and the stars were the gifts you gave
To the dark and the endless skies my love
To the dark and the endless skies."
- গানটাই শুনছিলাম।


নীরা তোমার চোখ জোড়া এত সুন্দর কেন? আমার কেন জানি মনে হচ্ছে "Victor Hugo" - তার "Les Misérables" উপন্যাসে তোমার এই দু'চোখ দেখার পরই "Cosette" (Euphrasie) - এর দু'চোখের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন "অতল সাগরের রহস্য সে চোখের চাহুনিতে।" শুধুকি তাই, এবার সূদুর ফ্রান্স থেকে ফিরে আসি বাংলায়; রবি ঠাকুর তার "হৈমন্তী" গল্পে হৈমন্তীকে নিয়ে লিখেছিলেন "ভারি একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা দুটি চোখ, এবং সাদাসিধা একটি শাড়ি । কিন্তু সমস্তটি লইয়া কী যে মহিমা সে আমি বলিতে পারি না" - আমার তো মনে হচ্ছে স্বংয় ভানু সিংহ - সেও তোমার দু'চোখ দেখার পরই হৈমন্তির এত সুন্দর অবয়ব এঁকেছিলেন। তাছাড়া মুনীর চৌধুরীও তোমার ঐ দু'চোখ দেখেছিলেন বলেই তার "রক্তাক্ত প্রান্তরে" ইব্রাহিম কার্দিকে দিয়ে জোহরা বেগমকে (মন্নু বেগ) বলিয়েছিলেন : "কতোদিন তোমাকে দেখিনি । তৃষ্ণায় দুচোখ পুড়ে খাকহয়ে গেছে । কতোকাল তোমার এই রূপ আমি দেখিনি । অশ্ব পৃষ্টে নয়, মাটির ওপরে দাঁরিয়ে তুমি । রক্তাক্ত তরবারি নয়, হাতে মেহেদি পাতার রং | ঐ আনত মুখ, ঐ নির্মিলিত চোখ -এত রূপ তোমার,একবার মুখ তুলে তাকাও আমার দিকে"। আর একটা গোপন কথা বলি তোমাকে, সেদিন আমি "ধূমকেতু'র" - ডায়রীটার কয়েক পাতা চুরি করে পড়েছিলাম সেও দেখি লিখে রেখেছে - "অতল "অতল সাগরের রহস্য সে চোখের চাহুনিতে! আমি তো একবার তাকালে আর নজর ফেরাতে পারিনা। কেন যে তুমি, ঐ চাহুনিতে চেয়েছিলে? সেদিন থেকেই ভেতরে ঝলসে গেছে! গন্ধ পাই! ভেতর থেকে বিভত্স গন্ধ হয় ! যার নাম - ভালবাসা"সাগরের রহস্য সে চোখের চাহুনিতে! আমি তো একবার তাকালে আর নজর ফেরাতে পারিনা। কেন যে তুমি, ঐ চাহুনিতে চেয়েছিলে? সেদিন থেকেই ভেতরে ঝলসে গেছে! গন্ধ পাই! ভেতর থেকে বিভত্স গন্ধ হয় ! যার নাম - ভালবাসা"। নীরা আমার তো মনে হয় এই ব্যাটা যাযাবর "ধূমকেতু"ও তোমার এই দু'চোখ দেখেছিল। না হলে ও এমন রোমান্টিক ভাষায় লিখতে পারত না। I am sure. নীরা, তোমাকে দেখার পর আমার ভেতর থেকেও অমন বিভৎস গন্ধ বের হচ্ছে। হয়ত এটার নামই ভালবাসা।

নীরা আমি সব সময় বর্তমান নিয়ে বাঁচতে ভালোবাসি। তবুও আমার অনেক স্বপ্ন আছে। "রঙিন রঙিন স্বপ্ন, ঠিক রংধনুর মত। স্বপ্ন দেখাটা নেশা না, আমারও পেশা। নিজে স্বপ্ন তো দেখি। কখনওবা অন্যের স্বপ্নকেও নিজের নামে চালিয়ে দেই! আমিও ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখি, রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে স্বপ্ন দেখি। কখনওবা স্বপ্ন দেখি দীর্ঘ লেকচারে ক্লান্ত হওয়া ক্লাসরুমটার শেষ বেঞ্চে বসে। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। নানা ধরনের স্বপ্ন। কখনো স্বপ্ন দেখি, আমিও এক চমৎকার প্রেমিক, কখনো এক রাঙা বউ এর আদরের স্বামী, কখনো স্বপ্ন দেখি আমিও এক ফুটফুটে সোনামনির গর্বিত বাবা। কখনো নিজেকে ভাবি ঝর্ণার উৎস, বৃষ্টির শব্দ, কখনো নিজেকে গোধূলী আকাশে পথহারা একাকী বলাকা, কখনো পৃথিবীর পথে নিরব হেঁটে চলা পথচারি। কখনো হাসপাতালে মৃত্যুর মুখোমুখি আমি, আমারও সামনে অশ্রুসজল প্রিয় মানুষের কাতর একজোড়া দৃষ্টি। আরো কত যে স্বপ্ন তার কি কোনো হিসাব আছে। তবে এটিও ঠিক পুরো স্বপ্ন আমারও কখনোই দেখা হয়ে উঠেনি কারণ আমার স্বপ্নেরাও বড় বেশী আধুনিক, তারাও প্রসব ব্যথার চেয়ে সিজারিয়ানকেই শ্রেয়তর ভাবে। তাই সব সময় আমার দু’চোখে ভরে থাকে অপূর্ণ মাতৃত্বের জমাট বাঁধা কান্না। নীরা আমি বরং মন ভাল করার ওষুধ হয়ে থাকতে চাই। আমার চারপাশে থাকবে অসংখ্য সুখী মানুষ। অসংখ্য সুখী মানুষের ভীড়ে একা অসুখী হয়ে হাউমাউ করে কাঁদবো। তখন তোমার মুখ থেকে শোনা একটি স্বান্তনা বাক্য আমাকে করবে অসম্ভব সুখী মানুষ। " নীরা আমিও বিশ্বাস করি পৃথিবীতে সবচাইতে বড় সাফল্য : ''মৃত্যুর আগেই নিজের মতো করে বেঁচে নেয়া...!" আমি নিজেকে "স্বপ্নহীন স্বপ্নওয়ালা" বলি; কিন্তু আমারও একটি গোপন স্বপ্ন আছে : আমার এপিটাফে আমিও যেন লিখতে পারি - "এখানে যে মানুষটি শুয়ে আছে, সে মৃত্যুর আগে বেঁচে ছিল! "যদি এটিও অপূর্ণ থেকে যায়, তবে Alexander Pope -এর মত আমিও বলব-


"Thus let me live, unseen, unknown;
Thus unlamented let me die;
Steal from the world, and not a stone
Tell where I lie."
- (Ode on Solitude).


নীরা তোমাকে আমার স্বপ্ন মনে হয়। নীরা তুমি আমার স্বপ্ন। যদি তুমি - "স্বপ্ন" টা এ জন্মে অপূর্ণ থাকে; "আরণ্যক বসু" যেমন তার প্রেমিকাকে আগেই বলে রেখেদিয়েছেন, তেমনি আমিও কিন্তু আগে থেকেই তোমাকে বলছি : "পরের জন্মে বয়স যখন ষোলোই সঠিক আমরা তখন প্রেমে পড়বো, মনে থাকবে? বুকের মধ্যে মস্তো বড় ছাদ থাকবে, শীতলপাটি বিছিয়ে দেব; সন্ধ্যে হলে বসবো দু'জন। একটা দুটো খসবে তাঁরা, হঠাৎ তোমার চোখের পাতায় তাঁরার চোখের জল গড়াবে, কান্ত কবির গান গাইবে, তখন আমি চুপটি ক'রে দুচোখভ'রে থাকবো চেয়ে... মনে থাকবে? এই জন্মের দূরত্বটা পরের জন্মে চুকিয়ে দেব, এই জন্মের চুলের গন্ধ পরের জন্মে থাকে যেন, এই জন্মের মাতাল চাওয়া পরের জন্মে থাকে যেন, মনে থাকবে? আমি হবো উড়নচন্ডি এবং খানিক উস্কোখুস্কো, এই জন্মের পারিপাট্য সবার আগে ঘুচিয়ে দেব, তুমি কাঁদলে গভীর সুখে, এক নিমেষে সবটুকু জল শুষে নেব, মনে থাকবে? পরের জন্মে কবি হবো তোমায় নিয়ে হাজারখানেক গান বাঁধবো। তোমার অমন ওষ্ঠ নিয়ে নাকছাবি আর নূপুর নিয়ে গান বানিয়ে__ মেলায় মেলায় বাউল হয়ে ঘুরে বেড়াবো... মনে থাকবে? আর যা কিছু হই বা না হই, পরের জন্মে তিতাস হবো, দোল মঞ্চের আবীর হবো, শিউলিতলার দুর্বো হবো, শরৎকালের আকাশ দেখার__ অনন্তনীল সকাল হবো; এসব কিছু হই বা না হই, তোমার প্রথম পুরুষ হবো, মনে থাকবে? পরের জন্মে তুমিও হবে নীল পাহাড়ের পাগলা-ঝোরা, গাঁয়ের পোষাক ছুড়ে ফেলে তৃপ্ত আমার অবগাহন। সারা শরীর ভ'রে তোমার হীরকচূর্ণ ভালোবাসা। তোমার জলধারা আমার অহংকারকে ছিনিয়ে নিল। আমার অনেক কথা ছিল, এ জন্মে তা যায়না বলা, বুকে অনেক শব্দ ছিল__সাজিয়ে গুছিয়ে তবুও ঠিক কাব্য করে বলা গেল না! এ জন্ম তো কেটেই গেল অসম্ভবের অসঙ্গতে, পরের জন্মে মানুষ হবো তোমার ভালোবাসা পেলে মানুষ হবোই__ মিলিয়ে নিও! পরের জন্মে তোমায় নিয়ে... বলতে ভীষণ লজ্জা করছে, ভীষণ ভীষণ লজ্জা করছে, পরের জন্মে তোমায় নিয়ে... মনে থাকবে?"

নীরা দু'-একটা না-বলা কথা সারা জীবন বৈদুর্যমণির মতন দীপ্যমান হয়ে থাকে বুকের মধ্যে... তাই আজ তোমাকে আমার মত স্বপ্ন-মানুষের জন্য লেখা, আমার একটি প্রিয় কবিতা তোমাকে বলছি।

"স্বপ্ন মানুষ"
- মহাদেব সাহা।

আমি হয়তো কোনোদিন কারো বুকে জাগাতে পারিনি ভালোবাসা,
ঢালতে পারিনি কোনো বন্ধুত্বের শিকড়ে একটু জল-
ফোটাতে পারিনি কারো একটিও আবেগের ফুল
আমি তাই অন্যের বন্ধুকে চিরদিন বন্ধু বলেছি;
আমার হয়তো কোনো প্রেমিকা ছিলো না,
বন্ধু ছিলো না, ঘরবাড়ি, বংশপরিচয় কিচ্ছু ছিলো না,
আমি ভাসমান শ্যাওলা ছিলাম,
শুধু স্বপ্ন ছিলাম;
কারো প্রেমিকাকে গোপনে বুকের মধ্যে
এভাবে প্রেমিকা ভেবে,
কারো সুখকে এভাবে বুকের মধ্যে
নিজের অনন্ত সুখ ভেবে,
আমি আজো বেঁচে আছি স্বপ্নমানুষ।
তোমাদের সকলের উষ্ণ ভালোবাসা,
তোমাদের সকলের প্রেম
আমি সারি সারি চারাগাছের মতন
আমার বুকে রোপণ করেছি,
একাকী সেই প্রেমের শিকড়ে আমি
ঢেলেছি অজস্র জলধারা।
সকলের বুকের মধ্যেই একেকজন নারী আছে,
প্রেম আছে, নিসর্গ-সৌন্দর্য আছে, অশ্রুবিন্দু আছে
আমি সেই অশ্রু, প্রেম, ও নারী ও স্বপ্নের জন্যে
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগেছি;
সকলের বুকের মধ্যে যেসব শহরতলী আছে,
সমুদ্রবন্দর আছে, সাঁকো ও সুড়ঙ্গ আছে, ঘরবাড়ি আছে
একেকটি প্রেমিকা আছে, প্রিয় বন্ধু আছে,
ভালোবাসার প্রিয় মুখ আছে
সকলের বুকের মধ্যে স্বপ্নের সমুদ্রপোত আছে,
অপার্থিব ডালপালা আছে।
আমি সেই প্রেম, সেই ভালোবাসা, সেই স্বপ্ন
সেই রূপকথার জীবন্তমানুষ হয়ে আছি;
আমি সেই স্বপ্নকথা হয়ে আছি,
তোমাদের প্রেম হয়ে আছি,
তোমাদের স্বপ্নের মধ্যে ভালোবাসা হয়ে আছি
আমি হয়ে আছি সেই রূপকথার স্বপ্নমানুষ । "

নীরা এখন তুমি হয়ত এই স্বপ্ন-মানুষটিকে প্রত্যাক্ষান করবে? অথবা বলবে "তোমার মনের বন্দরে নোঙ্গর করতে আমি বড্ড দেরি করে ফেলেছি। কিন্তু নীরা বিশ্বাস করো দোষ আমার নয় ; সব দোষ ঐ পথের! পথের দৈর্ঘ্য যদি একটু কম হতো... আমি আরো কয়েক যুগ আগেই তোমার কাছে পৌঁছাতাম।" নীরা আমি তোমার হৃদয় - রাজ্যের দখল নিতে চাইনা। শুধু সেখানে আশ্রয় নিতে চাই ; সামান্য একটু আশ্রয়! যেমন টা মেঘমালা নীলাকাশের বুকে আশ্রয় নেয়; অথবা নিঃসঙ্গ যাযাবর স্টেশনের ব্রেঞ্চে রাত কাটায়। এ রকম সামান্য একটু আশ্রয় হলেই চলবে আমার। আমি শুধু একটু পিছুটান সৃষ্টি করতে চাই। ছন্ন ছাড়া এই জীবনটাকে তোমার মায়ায় বাঁধতে চাই। নীরা, নির্মলেন্দু গুণের মত আমিও বলছি শোন "আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য। তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে, আমি জন্মেছিলাম তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য।"

নীরা একটা কবিতা লিখেছি। নাম দিয়েছি "বয়েস" শেষের কয়েকটা লাইন বলছি :

"লোকেরা ফের বুড় হবেই এবং মরবে
আমিও মরবো
আরও খানিকটা ভালোবেসে, আরও কয়েকটা পদ্য লিখে
আমিও ঠিক মরে যাবো,
কী, তাই না ?
ঘুরতে ঘুরতে কোথায় এলুম, এ-জায়গাটা আত অচেনা
আমার ছিল বিশাল রাজ্য, তার বাইরেও এত অসীম
শরীরময় গান-বাজনা, পলক ফেলতেও মায়া জাগে
এই ভ্রমণটা বেশ লাগলো, কম কিছু তো দেখা হলো না
অন্ধকারও মধুর লাগে, তোমার হাতটা দাও তো সুগন্ধ নিই !
নীরা, শুধু তোমার কাছে এসেই বুঝি
সময় আজো থেমে আছে ।"


নীরা, তোমাকে এই শেষ রাতে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। জানি এ অসম্ভব ইচ্ছে। নীরা আমি যদি জোঁনাক হতে পারতাম তবে, এই রাতে আমি তোমার চারপাশে আলোয় ভরিয়ে দিতাম। অথবা "রিকল্" ব্যান্ডের এই "যখন নিঝুম রাতে সব কিছু চুপ, নিষ্প্রাণ নগরীতে ঝিঁ ঝিঁ রাও ঘুম। আমি চাঁদের আলো হয়ে তোমার কালো ঘরে জেগে রই সারা নিশি। হুম এতটাই ভালবাসি।" গান টা যদি তোমার - আমার জিবনে সত্যি হত! জানি আমার স্বপ্ন সত্যি হবে না। হয়ত তোমাকে আমার কোন দিন পাওয়া হবে না। তোমার সাথে এমন ঝুম বৃষ্টির সন্ধ্যায় কেরামত কাকার দোকানে বসে দু'কাপ চা খাওয়াও হবে না। হয়ত তোমাতে - আমাতে আর কোন দিন দেখাও হবে না। তোমার হয়ত মনে হচ্ছে আমি হতাশাবাদী। ঠিক তা নয়। ঘটনা হলো, কলিমুদ্দি দফাদার - এর বিখ্যাত উক্তি টিকে মনে আছে তোমার? ঐ যে লেখক কলিমুদ্দি কে নিয়ে বলেছিলেন "হতভাগা যেখানে যায় সেখানে সাগর শুকিয়ে যায়"। নীরা ধরে নাও আমিও এমন হতভাগা! নীরা কান্না পাচ্ছে আমার। আমার খুউউউব কান্না পাচ্ছে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না। হয়ত প্রকৃতি চায় না তোমার-আমার দেখা হোক। নীরা আমারা হয়ত ট্রেনের রাস্তার মত সারা জিবন পাশাপাশি চলব, কিন্তু কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারব না। আমরা স্পর্শের বাইরে থেকে যাব! স্পর্শের বাইরে! নীরা, তারাপদ রায় তার প্রেমিকাকে একদিন বলেছিলেন :


"অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বত্সরের পর বত্সর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে তোমার সঙ্গে আমার
অথবা আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।"

 নীরা এটাই হয়ত আমার-তোমার জিবনেরও ন্যাকেড ট্রুথ : যে তোমার সঙ্গে আমার অথবা আমার সঙ্গে তোমার আর দেখা হবে না।"

নীরা, রুদ্র গোস্বামী একবার বলেছিলেন -

"প্রেমিক হতে গেলে ঋতু বুঝতে হয়
যেমন কোন ঋতুটার বুক ভরতি বিষ
কোন ঋতুটা ভীষণ একা একা, কোন ঋতুটা প্লাবন
কোন ঋতুতে খুব কৃষ্ণচূড়া ফোটে
ছেলেটা ঋতুই জানে না
ও শুধু দেখে আর চেনে, বুঝতে জানে না ।
ছেলেটা কখনো প্রেমিক হতে পারবে না
প্রেমিক হতে গেলে গাছ হতে হয় ।
ছায়ার মতো শান্ত হতে হয় ।
বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করতে হয় ।
জেদি মানুষেরা কখনও গাছ হতে পছন্দ করে না ।
তারা শুধু আকাশ হতে চায় ।"

নীরা এই কথা তিনি আমাকে বলেছেন হয়ত। তাই আমিও তোমার প্রেমিক হতে পারব না কোনদিন। নীরা তোমাকে ছাড়া আমি হয়ত বেঁচে থাকব। তবে আমার এই বেঁচে থাকাটা হবে অসম্পূর্ণ!

নীরা তুমি নীল শাড়ি পড়তে ভালবাস। নীল আমারও প্রিয় রঙ। কিন্তু আমার না নীল পাঞ্জাবী নেই। থাকলে মেঘ হয়ে আকাশের বুকে ইচ্ছে মতন ভেসে বেড়াতাম পাখীর মত, তুলোর মত অথবা নিদেনপক্ষে ধূলোর মত হলেও তুমিময় ঐ আকাশটায় আমিও অনন্তকাল লেগে থাকতাম। হ্যাঁ জানি, আকাশ ছোঁয়া যায় না তোমাকেও কি কোনদিন ছুঁতে পারব? পারব না হয়তো! তোমাকে ছোঁয়া যায় না কিছুতেই, তাতে এই বাউন্ডুলের কি আসে যায়! তুমি আকাশ হয়ে যাও নীরা; আমি আকাশ দেখতে ভালোবাসি, বড্ড ভালোবাসি...!!!"

ইতি,
মিঃ নোবডি দ্যা ইনোসেন্ট ডেভিল।

(নীরা বেডের উপরে চিঠিটা ফেলে রেখে, তার প্রিয় উত্তর - বেলকুনিতে দাড়িয়ে নিঝুম রাতের আকাশের বুকে ধ্রুবতাঁরা খুঁজতে লাগলো আর মাঝে মাঝে নীল শাড়ির আচল দিয়ে সেই দু'চোখ মুছতে থাকলো। যে দু'চোখের চাহুনির মাঝে সুনীল দা খুঁজে পেয়েছেন অতল সাগরের রহস্য!)


✍ লেখক :  ©  "ধূমকেতু" ll ০৮-০৮-২০১৭ ইং ll পাবনা ll



Photo : © Dhumkeatu's Canvas. 2017



   ﹋﹌﹋﹌﹋﹋﹌﹋﹌﹌﹋﹋﹌﹋﹌﹋﹌﹌﹋﹋﹌﹋﹌﹋﹋﹌﹋﹋﹌﹋﹌﹋﹋﹌﹋﹋﹌﹋


⚠⚠⚠ ® [This article of this blog is the intellectual property and copyright of © "Dhumkeatu"/"ধূমকেতু" & © Dhumkeatu's Diary is owned by #Shaon_Mr_Nobody. This post is provided for educational purposes and personal use only. Without permission unauthorized use or reproduction for any reason is prohibited. All Rights Reserved.]


📷 Photo source : © "Dhumkeatu's Canvas" ll 2014 ll

*** Official Facebook page : -
💌 www.facebook.com/DhumkeatusCanvas

*** Official Instagram ID :-
www.instagram.com/canvas_of_dhumkeatu/



👉👉 Join Dhumkeatu's Facebook pages :

📃  (!) "কবিতা এবং তুমি"
💌 www.facebook.com/KobitaEbongTumi

📃 (!!) "The Bohemian's Diary"
💌 www.facebook.com/TheBohemiansDiary


👉👉 Read Dhumkeatu's Favourite Articles :

📃 "The Bohemian's Diary"
🌍 www.nostalgicbohemian.blogspot.com



🔊🔉 Believe : "Happiness is a Choice & Life is Beautiful."
''Zindagi Na Milegi Dobara." Just keep Livin...!!!
Keep Smile.......!! Happy Living......!!! :) :) :)
Thank You, Good Luck......!!! :) :) :)💘💘💘


🌍 Copyright : © "Dhumkeatu's Diary" ll 02.02.2018 ll 🇧🇩


1 টি মন্তব্য:

প্রিয় গানের সংক্ষিপ্ত তালিকা...

**প্রিয় গানের সংক্ষিপ্ত তালিকা... ১) মন শুধু মম ছুঁয়েছে- সোলস ২)নিঃস্ব করেছ আমায় - শাফিন ৩)ফিরিয়ে দাও- মাইলস ৪)শ্রাবনের মেঘগু...